সবুজ স্বপ্ন
প্রথম সূর্যের আলোটা এসে পড়েছে মোহরের মুখটাতে । বিছানা থেকে উঠে জানলার পরদাটা টেনে দেয় চয়ন। আলতো হাতে মোহরের কপালের চুল-কটা সরিয়ে দেয়। একদম বাচ্চা মেয়ের মতো হাত-পা কুঁকড়ে কি নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। প্রতিদিন রাতে কেন যে এমন ভয় পাচ্ছে মোহর কে জানে !!!! পরশুদিন তো ডাক্তারবাবুর কাছে নিয়েও গিয়েছিল মোহরকে, উনিও যেন মনে হলো বিষয়টাকে তেমন গুরুত্ব দিলেন না। এসময় এমন একটু-আধটু হয় বললেন। হালকা ডোজের ঘুমের ওষুধও দিয়েছেন। কিন্তু তাতে কি? ভোরবেলা তো সেই একই কাণ্ড। বিছানায় মাথা রেখে শুলেই কারা যেন কাঁদছে, বাঁচাও-বাঁচাও বলে চিৎকার করছে । ভয় পেয়ে তখন কাতর ভাবে চয়নকে জড়িয়ে ধরে মোহর । বাচ্চা মেয়ের মতো চয়নের বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে কাঁপতে থাকে।
চয়ন অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছে, এখানে কেউ নেই কান্নাকাটি করার--- পুরোটাই স্বপ্ন, তবু মানতে চায়না মোহর।
দুবছর আগে বাচ্চাকে অ্যাবোরেশন করাতে হয়েছিল , সেই ভয়টাই মনে বাসা বেঁধে নেই তো !!!! কিন্তু সেই ট্রমাটা তো কাটিয়ে উঠেছিল মোহর। সাইক্রিয়াটিস্ট-গাইনোকোলোজিস্ট দুজনেই বলেছিলেন এবার বেবী এলে কোনো অসুবিধা নেই। সেবার না হয় মোহরের জন্ডিসটা অমন বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গিয়েছিল বলে, ডাক্তারবাবু বাচ্চাটাকে নষ্ট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু এবার তো কোনো সমস্যাই নেই। পাঁচটা মাস তো দিব্যিই ছিল। নতুন ফ্ল্যাটে আসা নিয়ে কতো খুশি-খুশি ছিল। কোথা থেকে যে কি হচ্ছে বুঝতে পারছে না চয়ন।
কলিংবেলটা বাজতেই বিছানা থেকে উঠে দরজাটা খুলে দিতে যায় চয়ন। কাজের মেয়েটা এসেছে নিশ্চয়। সকালবেলা আসে, রান্নাবান্না-কাজকর্ম সব একাই সামলায়। একেবারে সন্ধ্যেবেলা রাতের রান্না শেষ করে বাড়ি যায়। মোহর বলছিল, সুনীতা নাকি খুব ভালো। একেবারে নিজের মতো করে গুছিয়ে সব কাজকর্ম করে। নতুন জায়গায় কাজের লোক পাওয়া খুব ঝামেলার। কপাল ভালো যে একটা মনোমত কাজের লোক পাওয়া গেছে।
সুনীতা রান্নাঘরে রাতের এঁটো বাসনপত্র ধোয়ামাজা করছে তার খুটখাট আওয়াজ আসছে। টয়লেট থেকে বেরিয়ে সুনীতাকে দুকাপ চা করতে বলে চয়ন। আস্তে আস্তে ঘুম থেকে ডেকে তোলে মোহরকে।
শহরের ব্যস্ততা ছাড়িয়ে একটু ফাঁকার দিকে ফ্ল্যাটটা। যদিও কংক্রিটের অগ্রগতিতে সবুজ আর নেই, তবু কিছুটা আকাশ এখনো যেন অবশিষ্ট আছে।
দক্ষিণ খোলা ব্যালকনিটাই বেশ হু হু করছে হাওয়া।
চা খেতে খেতে একটু যেন চুপচাপ মোহর, অন্যদিনের মতো কথার ফুলঝরি ফুটছে না আজকে। ভোরবেলার ঘটনাটা মনে মনে ভাবছে নাকি এখনো?!
পরিস্থিতি সহজ করার জন্য চয়ন-ই কথা শুরু করলো।
---এখানে কত আলো আর এতদিনের ঐ এঁদো গলির একতলার ভাড়া বাড়িতে একচিলতে আলোও ঢুকতো না। দিনের বেলা অবধি লাইট জ্বেলে থাকতে হতো। ভাগ্যিস তুমি একটা ফ্ল্যাটের জন্য জোর করেছিলে, নাহলে সারাজীবন ওখানেই পচে মরতে হতো আমাদের।
বৌয়ের প্রশংসা করলে সচরাচর খুশি হয় বউরা। কিন্তু মোহর কেমন যেন উদাসীন। চয়ন তখনো বলে চলেছে,
----- তবে এদিকেও আর বেশিদিন ফাঁকা থাকবে না। চারদিকে দেখো কত ফ্ল্যাট উঠছে। অফিসে ব্যানার্জ্জীদা বলছিল, আমাদের আশপাশে একটা ফ্ল্যাট দেখে দিতে। সেদিন ফোন করলাম প্রোমোটারকে, স্কোয়ার ফিটে চারশ টাকা করে বেড়ে গেছে।
জানো সুনীতা, বলছিল, এই ফ্ল্যাটগুলো হওয়ার আগে এখানে অনেক বড়ো বড়ো গাছ ছিল। আর ঐ পিছন দিকটায় নাকি একটা বড়ো দিঘী ছিল।
----হ্যাঁ জানি তো , একমুখ হেসে মোহরের কথার জবাব দেয় চয়ন ।
----জানো তো আমরা যখন সেভেনে পড়ি, ইংরাজী স্যার আমাদের ঐ দিঘীর ধারে পিকনিক করতে নিয়ে এসেছিলেন। উফ্! উচুঁ উচুঁ গাছের ফাঁকে দিনের বেলাও যেন ছায়া ছায়া অন্ধকার। আর কতরকম পাখির ডাক, সে তুমি না শুনলে ধারণাও করতে পারবে না। ছোটবেলার অনুভূতিতে সেদিন নিজেকে আফ্রিকার জঙ্গলে শঙ্করের মতো মনে হচ্ছিল।
নিজের কথাতে নিজেই হেসে ওঠে চয়ন ।
----অত গাছ সব কেটে ফেললো?!! দিঘীটার কি হলো?
মনখারাপের সুরে কথাদুটো বলে মোহর ।
----আরে গাছপালা না কাটলে জমি পাবো কোথায়? যা ফাঁকা জায়গা সব তো মানুষের সভ্যতার ইমারতে ভরে গেছে। নতুন বাড়ি-কলকারখানা বানাতে জমি তো লাগবে নাকি !!
----তাই বলে গাছগুলোকে কেটে ফেলবে ? গাছগুলোর বুঝি প্রাণ নেই, ওদের বুঝি কষ্ট হয়না? কত পাখি ঘরছাড়া হয়েছে খবর রেখেছে? ওদের কথা না ভাবো, গাছ আমাদের কত উপকার করে জানো না? এইভাবে গাছ কাটতে থাকলে একদিন তো.....
কথা কটা বলতে বলতে কেঁদে ফেলে মোহর ।
চয়ন যেন এই পরিস্থিতিটার জন্য তৈরি ছিলনা। যা বাব্বা! গাছগুলো কি চয়ন কেটেছে নাকি? ওকে কেন দোষারোপ করছে মোহর ?!!
----আমি কেটেছি নাকি গাছগুলো যে আমাকে বলছো.....
----তুমি কাটোনি, কিন্তু যারা কেটেছে তারা তোমার মতোই স্বার্থপর। তোমরা শুধু নিজেদের কথাই ভাবো, কারো যন্ত্রণা বোঝোনা।
একটা প্রাণকে উপড়ে ফেলার যন্ত্রণা আমি জানি। আমার শরীর থেকেও একটা প্রাণ তোমরা......আমি রাত্তিরবেলা ঐ গাছগুলোর কান্না শুনতে পাই। ওরা বাঁচাও বাঁচাও করে কাঁদে। আমার ভীষণ ভয় করে। ওদের কান্নায় আমার সন্তানের পৃথিবীতে আসার পথ না পিছল হয়ে যায়....
কথাটা শেষ না করেই ঘরে চলে যায় মোহর।
এ যেন এক নতুন মোহরকে দেখছে চয়ন। এইজন্য ও রাতে দিনের পর দিন ভয় পাচ্ছে !!!!
অফিস বেরনোর সময় টুকটাক কাজের কথা ছাড়া কথা হলোনা মোহরের সাথে।অফিসে এসেও মনটা তিতকুটে হয়ে আছে চয়নের। কিভাবে মোহরের মনের মেঘ কাটাবে বুঝতে পারছে না! কাল শনিবার অফিস ছুটি আছে। এমনিতেও পয়লা বৈশাখ। দুদিনের জন্য না হয় বাপেরবাড়ি থেকে ঘুরিয়ে আনবে মোহরকে, মনটা তাতে যদি কিছুটা ভালো হয়!
ফোন করে প্ল্যানটা বলতেও খুশি হলোনা মোহর।
----এই তো গৃহপ্রবেশের দিন-ই বাবা-মা-দাদা এসেছিল, এখনি আবার ওখানে যাওয়ার কি আছে? পরে যাওয়া যাবে....শোনো আসার সময় সুনীতার জন্য একটা সালোয়ার-কামিজ নিয়ে এসো তো। পয়লা বৈশাখে দেবো মেয়েটাকে। একটু না দিলে-থুলে মন দিয়ে কাজ করবে না।
ফোনটা রাখার আগে নীচুস্বরে বলে,
--বেশি দামের নেওয়ার দরকার নেই ।
সুনীতা কাছাকাছি আছে বলেই শেষটুকু চাপাস্বরে বললো বোধহয়। যাক্! সকালের পরিস্থিতি একটু বোধহয় স্বাভাবিক হয়েছে।
সুনীতার সালোয়ার-কামিজ কিনতে ঢুকে একটা শাড়ি পছন্দ হয় মোহরের জন্য। দামটা একটু বেশি, তাই নেব কি নেবে না ভাবছে। তখনি খেয়াল করে দোকানের উল্টোদিকের ফুটপাতে।মনটা আনন্দে নেচে ওঠে চয়নের। মোহরেরও নিশ্চয় খুব খুশি হবে গাছগুলো পেয়ে।
অনেকটা রাত, নীল মৃদু আলোতে ঘড়ি দেখা যাচ্ছে না। জানলার ভারী পর্দার ফাঁক দিয়ে বাইরেটা দেখা যাচ্ছে। চাঁদের আলোয় একটা আলো আলো অন্ধকার।
চয়নের কোলের কাছে শুয়ে ওর বুকে আঙুলে করে আঁকিবুকি কাটছে আর বকরবকর করে চলেছে মোহর।
----কাল সকালেই আমাকে টব আর মাটি এনে দেবে। একটু বড়ো সাইজের টব আনবে, নাহলে খোলামেলাভাবে বড়ো হতে পারবেনা গাছগুলো। আর শোনো, একটু সার এনে দিয়ে তো! খাবার তো লাগবে গাছগুলোর।
মোহরের শরীরের উষ্ণতা আর খুশি ছুঁয়ে যাচ্ছে চয়নকে। চোখ বুজে সুখটুকু অনুভব করছে।
---কি গো, ঘুমিয়ে গেলে?
---না....
---বলছি ও আসার আগে গাছগুলো অনেকটা বড়ো হয়ে যাবে, তাই না? ফুলও ফুটবে হয়তো!
চয়নের হাতটা টেনে নিজের পেটের ওপর ছোঁয়ায় মোহর।
---পুরো ব্যালকনিটা অনেক অনেক গাছে ভরিয়ে দেব। তবে না ছোট থেকে গাছকে ভালোবাসতে শিখবে পুচকুটা।
চয়নের উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলে চলেছে মোহর।সবুজের স্বপ্নে বিভোর তখন মোহর। সকালের অপরাধবোধ থেকে যেন মুক্তি পেল চয়ন! রাতের ভয়টা মোহরের মনে আর ফিরে না এলেই মঙ্গল।ও তো এমন করেই খুশি রাখতে চায় মোহরকে।
মোহরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে চয়ন।
----সকালে দুজনে মিলে গাছগুলোকে টবে লাগাবো, রোজ দুজনে জল দেবো, দেখবে কত তাড়াতাড়ি ওরা বড়ো হয়ে যাবে। রাত হলো, এবার তো ঘুমোই ....মোহরকে নিজের আরো কাছে টেনে নেয় চয়ন।
(সমাপ্ত)
0 Comments